স্ট্রোক হলে তাৎক্ষনিক করনীয়

স্ট্রোক কি? 

স্ট্রোক হল মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহের অভাবের জন্য মস্তিষ্কের কিছু অংশের তাৎক্ষণিকভাবে কার্যহীন হয়ে যাওয়া এবং মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এমন অঙ্গগুলি যেমন, মুখমন্ডল, হাত- পা' র অসারতা ( প্যারালাইসিস), চারিদিক শূন্য দেখা, তীব্র অস্বস্তি, কথায় জড়তা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল  অবস্থা।


স্ট্রোক হলে তাৎক্ষনিক করনীয়


স্ট্রোক কিভাবে বুঝবেন ?

স্ট্রোকের সাথে অনেকে হার্ট অ্যাটাককে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।

স্ট্রোক মূলত মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানে। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো মরে গেলে স্ট্রোক হয়।



স্ট্রোকের লক্ষন

  • হঠাৎ করে শরীরের একাংশ অবশ বা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
  • হটাৎ প্রচন্ড মাথাব্যথা ও বমি হওয়া।
  • খাবার খাওয়ার সময় ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া
  • মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে যাওয়া
  • হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা বা কানে কম শোনা
  •  হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া।
  •  কথা জড়িয়ে যাওয়া বা একেবারেই কথা বলতে না পারা।
  • স্বাভাবিক পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সত্বেও  শরীর অত্যন্ত দুর্বল লাগা

মনে রাখা দরকার, এই সমস্ত লক্ষণগুলি যদি বার বার অর্থাৎ কিছুদিন পরপর ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকে, তবেই এব্যাপারে একটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। গরমের সময় দুপুরের রোদে বের হলে যে কোন মানুষেরই জলের অভাবের জন্য একটু মাথা ঘুরে যেতেই পারে। সেটাকে নিশ্চয়ই আমরা স্ট্রোকের একটি লক্ষণ এর মধ্যে ধরবো না।

স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক কী করণীয়


জরুরি চিকিৎসা (অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে)
  • শ্বাসনালি, শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্তসঞ্চালন নিয়মিত রাখা।
  •  রোগীকে একদিকে কাত করে, বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে।
  •  চোখের যত্ন নিতে হবে।
  •  মূত্রথলির যত্ন (প্রয়োজনে ক্যাথেটার দিতে হবে)।
  • খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বহু সুস্থ ও সাধারণ মানুষের বিনা কোন লক্ষণ ছাড়াই স্ট্রোক হয়। সে ক্ষেত্রে রোগীর বয়স ও তার নিজস্ব জীবনযাপন সংক্রান্ত হয়তো কোন সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়স্করা স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেও অল্প বয়সীদেরও এ সমস্যা হতে পারে। তাই যেকোনো বয়সে স্ট্রোকের কোনো লক্ষণ দেখা দিলেই অবহেলা করা চলবে না। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, স্ট্রোকের রোগীর জন্য সময় মহামূল্যবান। সময় পেরিয়ে গেলে মূল চিকিৎসার সুযোগ কমে যায়। তখন কেবল সহায়ক চিকিৎসা চলে। এতে পরবর্তী জীবনের জটিলতাগুলো এড়ানো সম্ভব হয় না। কাজেই ছোট-বড় সব লক্ষণের ক্ষেত্রেই সচেতন থাকতে হবে।

ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে তাঁর স্ট্রোক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।ছোট–খাটো লক্ষণকে পাত্তা না দেওয়ার কারণে স্ট্রোক হয়েছে বুঝতে অনেকটা মূল্যবান সময় চলে যায়। 

স্ট্রোক হয়েছে বুঝতে পারলেই কাছের যেসব হাসপাতালে সর্বাধুনিক চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে, বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে রোগীকে তেমন কোনো হাসপাতালে নিতে হবে। প্রয়োজনে কাছের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিতে হবে। সম্ভব হলে মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরন বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্ট্রোক দুই ধরনের হয়। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ার জন্য অথবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য এবং যার চিকিৎসাপদ্ধতিও ভিন্নতর।

স্ট্রোকের লক্ষণ একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়। অনেকে স্ট্রোক হওয়ার কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে যান। এ কারণে আর চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। এতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

লক্ষণ ও পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে চিকিৎসকরা একটি শব্দ মাথায় রাখতে বলেছেন। সেটা হল: FAST

এখানে F = Face মুখ বেঁকে যাওয়া, A = Arm হাত অবশ হয়ে আসা, S = Speech কথা জড়িয়ে যাওয়া বা এবং T = Time যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।

স্ট্রোকের রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া প্রসঙ্গে আপনার জেনে রাখা ভালো, বর্তমানে নেট দুনিয়ায় স্ট্রোকের ক্ষেত্রে হাতে, কানে, লতিতে বা হাতের আঙ্গুলে সুচ ফুটিয়ে রক্ত বের করার যে ভাইরাল উপায় রয়েছে সেটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাই রোগীর ওপর এ ধরনের ভ্রান্ত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকুন।


বাংলাদেশে স্ট্রোকের হার প্রতি হাজারে ৫-১২। আর প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে আছে।


স্ট্রোকের বিভিন্ন কারণ

  1.  উচ্চ রক্তচাপ: অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান ঝুঁকির কারণ। এটি রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে এবং এগুলোর ব্লকেজ বা ফেটে যাওয়ার জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
  2.  ধূমপান: ধূমপান রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
  3.  ডায়াবেটিস: রক্তনালী ও স্নায়ুর সম্ভাব্য ক্ষতির কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  4.  উচ্চ কোলেস্টেরল: এলডিএল কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা ধমনীতে প্লাগ তৈরি করতে পারে এবং ব্লকেজ এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  5.  অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন: অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনের মতো অনিয়মিত হার্টের ছন্দের কারণে হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা মস্তিষ্কে পৌঁছে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
  6. স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় হওয়া ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
  7.  পারিবারিক ইতিহাস: স্ট্রোক বা হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে কিছুটা হলেও ঝুঁকি থাকে।
  8.  এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপ, হতাশা, ডিপ্রেশনের কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোক রোগীদের সুস্থ জীবনযাপন

স্ট্রোকের রোগীদের নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। প্রতিদিন সম্ভব না হলে, কমপক্ষে সপ্তাহে তিন দিন ব্যায়াম অবশ্যই করতে হবে। এতে রোগী পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি মুক্ত থাকতে পারেন। সেই সাথে সাথে রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, লবণ কম খাওয়া ও পরিমিত খাবার গ্রহণের অভ্যাস ম্যান্ডেটরি। নিয়মিত চিকিৎসা ও ব্যায়াম চালিয়ে গেলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।


স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়

বিশেষ করে যদি ঝুঁকির কারণ বা স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, সেক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা মেনে চলা উচিত। স্ট্রোক এর কারণ তো আমরা আগেই জেনে নিয়েছি। ঝুঁকি কমাতে নিচের পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পারেন।


স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিন

ফল, সবজি, শস্যদানা, লো স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও সোডিয়াম সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।


রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন


নিয়মিত আপনার রক্তচাপ পরীক্ষা করুন এবং উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে মেডিসিন গ্রহণ করুন।


ধূমপান ত্যাগ করুন


ধূমপান পরিত্যাগ স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও থাকে এক্ষেত্রে। তাই এই অভ্যাস বাদ দিতে হবে।


ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন


প্রয়োজনে খাদ্য, ব্যায়াম ও ওষুধের মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।


নিয়মিত ব্যায়াম করুন


সঠিক ওজন ধরে রাখতে ও ফিট থাকতে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করুন।


প্রয়োজনীয় মেডিসিন গ্রহণ করুন


উচ্চ রক্তচাপ অথবা হাই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দেশিত মেডিসিন গ্রহণ করুন। অনেকে আছেন ঠিকমতো ওষুধ সেবন করেন না, গাফিলতি করেন! এই অভ্যাস পরিহার করুন।

সূত্রঃবিবিসি,কোরা


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url